bn বাংলা
বাংলা বাংলা
English English
عربي عربي


+8801575-547999
সকাল ৯টা হতে রাত ১০টা
Community Welfare Initiative

যিলহজের প্রথম দশকের আমলসমূহ

إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَىٰ آلِهِ وَأَصْحَابِهِ، وَسَلَّمَ تَسْلِيمًا كَثِيرًا.

অতঃপর:

আল্লাহর বান্দাগণ, আপনারা যথাযথভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন এবং নির্জনে ও গোপনে তাঁকে ভয় করে চলুন।

হে মুসলিমগণ!

আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে কল্যাণের মৌসুমগুলো নবায়ন হয়; এগুলোর কোনো একটি সমাপ্ত হলে ইবাদতের আরেক মৌসুম শুরু হয়; যাতে বান্দা তার পাপ-পঙ্কিলতা ধুয়ে ফেলতে পারে এবং এর দ্বারা তাদের মর্যাদা উন্নীত হয়।

আমাদের মাঝে যিলহজ মাসের বরকতময় প্রথম দশক আগমণ করেছে। এগুলোই সর্বশ্রেষ্ঠ, ফযীলতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ দিন যার রাতগুলোর শপথ করে আল্লাহ তা‘লা বলেন,

﴿وَٱلۡفَجۡرِ ١ وَلَيَالٍ عَشۡرٖ ٢﴾ [الفجر: ١،  ٢] 

“শপথ ফজরের। শপথ দশ রাত্রির।”[১]

মাসরূক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এগুলো হলো আযহার দশদিন যা বছরের শ্রেষ্ঠ দিন।” এগুলো আল্লাহর সম্মানিত দিনগুলোর অন্তর্ভুক্ত এবং নির্দিষ্ট মাসগুলোর শেষাংশ যে মাসগুলো সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلۡحَجُّ أَشۡهُرٞ مَّعۡلُومَٰتٞۚ﴾ [البقرة: ١٩٧] 

“হজ হয় সুনির্দিষ্ট মাসগুলোতে।”[২]

কা‘ব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “হারাম মাসসমূহের মধ্যে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় হলো যিলহজ মাস, আর যিলহজ মাসের মধ্য থেকে এর প্রথম দশকটি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।” এমনকি এই দশকের দিনগুলো রমদ্বানের শেষ দশকের দিনগুলোর চেয়েও উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَفْضَلُ أَيَّامِ الدُّنْيَا أَيَّامُ الْعَشْرِ»

যিলহজের প্রথম দশকের দিনগুলো দুনিয়ার সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ দিন।”[৩]
শাইখুল ইসলাম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “যিলহজের এই দশ দিন রমদ্বানের শেষ দশ দিনের চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ। আর রমাদ্বানের শেষ দশ রাত যিলহজের প্রথম দশকের রাতগুলোর চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ।”

যেহেতু এই মৌসুমে সালাত, সিয়াম, দান-সাদাকাহ, হজ ইত্যাদি প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলো একত্রে পালন করা যায়, যা অন্য মৌসুমে সম্ভব নয়, তাই যিলহজের প্রথম দশকের এতো মর্যাদা ও ফযীলত।

রাত ও দিনসমূহের মাঝে মৌসুমভিত্তিক পার্থক্য ও শ্রেষ্টত্বের দাবি হচ্ছে— উক্ত মৌসুমে যেসব কল্যাণ রয়েছে তা মূল্যায়ন করা। এ দশককে মূল্যায়নের উপায় হলো—এ সময়ে বেশি বেশি সৎ আমল করা। কেননা যেকোনো সৎ আমল এই মৌসুমে সম্পাদন করা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, হুবহু একই আমল অন্য সময়ে সম্পাদন করার চেয়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا العَمَلُ فِي أَيَّامٍ أَفْضَلَ مِنْهَا فِي هَذِهِ؟» قَالُوا: وَلاَ الجِهَادُ؟ قَالَ: «وَلاَ الجِهَادُ، إِلَّا رَجُلٌ خَرَجَ يُخَاطِرُ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ بِشَيْءٍ»

“এ দিনগুলোর আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন: জিহাদ করাও কি নয়? তিনি বললেন: জিহাদও নয়, তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।”[৪]

ইবন রজব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, দুনিয়ার যেকোনো দিনের চেয়ে শর্তহীনভাবে এই দশ দিনের আমল আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।” সালাফে সালেহীন এ সময়ে অধিক পরিমাণে সৎ আমলের চেষ্টা করতেন। “সাঈদ ইবন জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ যিলহজ মাস শুরু হলে প্রথম দশকে অত্যধিক সাধনা করতেন যার, পরিমাপ করা যেত না।”

আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম দয়া ও অনুগ্রহ যে, এই মৌসুমে বিভিন্ন রকমের ইবাদত ও আনুগত্যমূলক কাজ করা যায়। এ সময়ের শরীয়তসম্মত আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ﴾ [الحج: ٢٨]  

“যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।”[৫]

ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, “আর সে দিনগুলো হলো যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন।” ফলে এই সময়গুলোতে আল্লাহর যিকির করা সর্বোত্তম ইবাদতের শামিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ، وَلَا أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنَ الْعَمَلِ فِيهِنَّ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ الْعَشْرِ؛ فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّهْلِيلِ، وَالتَّكْبِيرِ، وَالتَّحْمِيدِ»

“যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল আল্লাহর কাছে অধিক গুরুত্ববহ ও প্রিয় নয়। অতএব এ দিনগুলোতে তোমরা বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ পাঠ কর।”[৬]

ইমাম নাওয়াওয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এই দশ দিনে অন্যান্য নফল আমলের চেয়ে বেশি বেশি যিকির করা মুস্তাহাব। আর আরাফার দিবসের যিকির এই দশ দিনের বাকী দিনগুলোর চেয়ে আরো উত্তম।” কুরআন তিলাওয়াত করা সর্বোত্তম যিকির; কেননা এতে আছে হেদায়াত ও স্পষ্ট জ্যোতি। সাধারণভাবে এই দশকে সর্বদা তাকবীর পাঠ করা যিলহজের প্রথম দশকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। “যিলহজের প্রথম দশকের দিনগুলোতে ইবন উমর ও আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বাজারে গিয়ে তাকবীর ধ্বনি দিতেন, তাদের তাকবীর ধ্বনি শুনে বাজারের লোকজনও তাকবীর পাঠ করতেন।”[৭] আর বিশেষভাবে ফরয সালাতের পর নির্দিষ্ট তাকবীর পাঠ করাও বৈধ, যা হাজীগণ ও অন্যান্যরা আরাফার দিন ফজর থেকে আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন পর্যন্ত পাঠ করবেন।

দান-সাদাকাহ করাও একটি সৎ আমল, যা দ্বারা বিপদে মুক্তি মেলে ও দুশ্চিন্তা দূরীভুত হয়। বিশেষ করে যদি অভাবের সময় ও কল্যাণের মৌসুমে হয়ে থাকে, তাহলে তো সেটা আরো উত্তম! নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ، كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ – وَأَحْسِبُهُ قَالَ – وَكَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ»

“বিধবা ও মিসকীনদের ভরণপোষণে সচেষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদের ন্যায়। বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় তিনি এও বলেছেন: ঐ ব্যক্তি অক্লান্ত সালাত আদায়কারী ও অনবরত সিয়াম সাধনাকারীর সমতূল্য।[৮]

এই দশকের আরেকটি মুস্তাহাব আমল হচ্ছে— প্রথম নয় দিন সিয়াম রাখা। ইমাম নাওয়াওয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এ দিনগুলোতে সিয়াম রাখা অনেক উত্তম আমল।” আর আরাফার দিনের সিয়াম “বিগত বছর ও বর্তমান বছরের গুনাহ মিটিয়ে দেয়।”[৯] তবে হাজীদের জন্য এ দিনে সিয়াম না রাখাই উত্তম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের অনুসরণে এবং এ দিনে যেন বেশি বেশি দো‘আ ও বিনয়তা প্রকাশে সক্ষম হয় সে আশায়।

আরাফার দিবস হলো মুসলিমদের প্রকাশ্য মিলনমেলা। এ দিনটি আল্লাহর নিকট কামনা ও আশঙ্কা ব্যক্ত করা এবং তাঁর প্রতি বিনয়াবনত হওয়ার দিন। এটা মুসলিমদের জন্য মূল্যবান দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ، مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ»

“আরাফার দিবসের তুলনায় এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক লোককে জান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন।”[১০]

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “আরাফার দিন বিকেলে হাজীদের হৃদয়ে যে ঈমানী শক্তি, রহমত, নূর ও বরকত নাযিল হয় তা বর্ণনাতীত।”

দো‘আ একটি উচ্চ মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর মাধ্যমে বান্দা তার চাহিদাগুলো মাওলার কাছে তুলে ধরে, তাঁর অবিরত অনুগ্রহ কামনা করে এবং এ আদেশটি পালনার্থে হৃদয় উজাড় করে তাঁর অভিমূখী হয়: ﴿فَٱدۡعُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ “কাজেই আল্লাহর ইবাদত কর তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে।”[১১]

সুতরাং আরাফার ময়দানে ও অন্যান্য সময়ে আপনার চাওয়া তাঁর নিকটে ব্যক্ত করুন এবং আপনার বিপদের তাঁর নিকটেই মুনাজাত করুন, দো‘আ কবুলের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন এবং মহাদাতার নিকট দো‘আয় মিনতি করুন। কেননা তিনিই স্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী:

﴿إِنَّمَآ أَمۡرُهُۥٓ إِذَآ أَرَادَ شَيۡ‍ًٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٨٢﴾ [يس: ٨٢] 

“তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, তিনি যখন কোনো কিছুর ইচ্ছে করেন, তিনি বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।”[১২]

যিলহজের এই দশকেই রয়েছে কুরবানীর দিন যা আল্লাহর নিকট অধিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ أَعْظَمَ الْأَيَّامِ عِنْدَ اللَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَوْمُ النَّحْرِ»

“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন দিন হলো কুরবানীর দিন।”[১৩] এ দিনটি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজে কুরবানীর দিনের ভাষণে বলেন,

«أَلَا إِنَّ أَحْرَمَ الْأَيَّامِ يَوْمُكُمْ هَذَا، وَإِنَّ أَحْرَمَ الشُّهُورِ شَهْرُكُمْ»

“সাবধান! তোমাদের এই দিন সর্বাপেক্ষা সম্মানিত দিন। সাবধান তোমাদের এই মাস সর্বাপেক্ষা সম্মানিত মাস।”[১৪]

এ দিনটি মুসলিমদের দুই ঈদের অন্যতম একটি দিন এবং এটি ইসলামের একটি রুকন আদায়ের মাধ্যমে খুশি ও আনন্দ উদযাপনের দিন। এ দিনটি হজের কার্যদিবসের মধ্যে উত্তম দিন, অধিক উদ্ভাসিত ও সর্বাধিক কার্যকে সমন্বয়কারী একটি দিন। এ দিনকেই বলা হয় ‘বড় হজের দিন’। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَذَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦٓ إِلَى ٱلنَّاسِ يَوۡمَ ٱلۡحَجِّ ٱلۡأَكۡبَرِ﴾ [التوبة: ٣] 

“আর মহান হজের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা…।”[১৫]

কুরবানীর দিনেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী ও মুমিনদেরকে সংবাদ দিলেন যে, তিনি তাদের জন্য দীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। ফলে তারা কখনো কিছু সংযোজনের প্রয়োজন অনুভব করবে না। তিনিই এটাকে সম্পূর্ণ করেছেন, তাই তাতে কোনো ঘাটতি রাখবেন না এবং এটার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, তাই কখনো এটাকে ঘৃণা করবেন না। এ মর্মে তিনি বলেন,

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائ‍دة: ٣]

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।”[১৬]

ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এ উম্মতের ওপর এটা আল্লাহর এক বিশাল অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের জন্য তাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। ফলে তারা অন্য দীনের এবং তাদের নবী ব্যতীত অন্য নবীর প্রয়োজন অনুভব করবে না।”

কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নবীকেই স্বীয় উম্মতের নিকট রিসালাত পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আর তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”[১৭]

কুরবানীর দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন:

«هَلْ بَلَّغْتُ؟، قَالُوا: نَعَمْ، قَالَ: اللَّهُمَّ اشْهَدْ»

“আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? তারা বললেন: হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন: হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।”[১৮]

এ দিনেই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে মানুষের কাছে দীনের তাবলীগ করতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:

«فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الغَائِبَ؛ فَرُبَّ مُبَلِّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ»

“উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়; কেননা এমন অনেক ব্যক্তি আছে যার নিকট ইলম পৌঁছানো হয় তিনি শ্রোতার চেয়ে বেশি হৃদয়ঙ্গমকারী হয়ে থাকেন।”[১৯]

মুজহেরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও অন্যান্য শরয়ী ইলম শিক্ষাদানের প্রতি উৎসাহ প্রদান রয়েছে। কেননা যদি শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ না থাকে তাহলে মানুষের নিকট থেকে ইলম চলে যাবে।”

কিন্তু ঈদের খুশির মধ্যেও অনেকেই আল্লাহর যিকির করতে ভুলে যায়! অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖ﴾ [البقرة: ٢٠٣] 

“আর তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর।”[২০]

ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, “এ নির্দিষ্ট দিনগুলো হলো আইয়ামে তাশরীক। এগুলো কুরবানীর দিনের পরের তিন দিন।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَيَّامُ التَّشْرِيقِ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ وَذِكرٍ لِلَّهِ»

“আইয়ামে তাশরীক হলো পানাহার ও আল্লাহর যিকির করার দিন।”[২১]

ইবন হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “যিলহজের প্রথম দশকের ফযীলত প্রমাণিত, আর এর দ্বারা আইয়ামে তাশরীকেরও ফযীলত প্রমাণিত হয়।” কুরবানী ও তাশরীকের দিনগুলোতে রয়েছে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত যা আল্লাহর কাছে অত্যধিক প্রিয় আমল। এই ইবাদতকে সালাতের সাথে উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “কাজেই আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন।”[২২] আল্লাহ তা‘আলা উৎসাহ দিয়েছেন যেন ইখলাসের সাথে কুরবানী করা হয় এবং এক্ষেত্রে যেন অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন উদ্দেশ্য হয়। গর্ব, অহংকার, লোক দেখানো, সুনাম অর্জন অথবা সামাজিকতার খাতিরে কুরবানী করা উদ্দেশ্য যেন না হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ﴾ [الحج: ٣٧] 

“আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না সেগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”[২৩]

হাদীসে এসেছে:

«ضَحَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ، ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ»

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে শিং বিশিষ্ট সাদা কালো রংয়ের হৃষ্টপুষ্ট দুটি দুম্বা কুরবানী করেছেন।”[২৪]

কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে উত্তম হলো: যা মানুষের নিকট উচ্চ দামের ও মানে সেরা। মুসলিম ব্যক্তির এমন পশুর উচ্চ মূল্যের কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করা উচিত নয়; কেননা এর প্রতিদান আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। একটি বকরী কুরবানী ব্যক্তি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয়ে যাবে। ঋণ করে কুরবানী করলেও তাতে সমস্যা নেই। কাজেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে কুরবানী করুন এবং নিজেরা তা থেকে আহার করুন, অন্যদেরকে খাওয়ান ও কিছু সাদাকাও করবেন। তবে সদকার করার ক্ষেত্রে  গরীবদেরকে প্রাধান্য দিন এবং হাদিয়া হিসেবে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদেরকে প্রদান করুন।

যিনি কুরবানী করার নিয়ত করেছেন তার জন্য এই দশকে নিজের চুল ও নখ কাটা নিষেধ। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ كَانَ لَهُ ذِبْحٌ يَذْبَحُهُ فَإِذَا أُهِلَّ هِلَالُ ذِي الْحِجَّةِ، فَلَا يَأْخُذَنَّ مِنْ شَعْرِهِ، وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ شَيْئًا حَتَّى يُضَحِّيَ»

“যার কাছে নিজে কুরবানী করার পশু রয়েছে, যিলহজের নতুন চাঁদ দেখতে পেলে সে যেন কুরবানী করার আগে তার চুল ও নখ না কাটে।”[২৫]

রহমত ও কল্যাণের মৌসুমে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ভয়াবহতা অনেক বেশি। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡرٗا فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ يَوۡمَ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ مِنۡهَآ أَرۡبَعَةٌ حُرُمٞۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُۚ فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ﴾ [التوبة: ٣٦] 

“নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহ্ বিধানে আল্লাহর কাছে গণনায় মাস বারোটি। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। কাজেই এর মধ্যে তোমর নিজেদের প্রতি যুলুম করো না।”[২৬]

কাতাদা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “অন্যান্য মাসের চেয়ে নিষিদ্ধ মাসসমূহে অন্যায় করা অধিক মারাত্মক গোনাহ যদিও অন্যায় সর্বদা-ই মারাত্মক, কিন্তু আল্লাহ স্বীয় ইচ্ছায় যেকোনো বিষয়কে অধিক সম্মানিত করেন।”

পরিশেষে হে মুসলিমগণ!

সৌভাগ্যবান তো সেই ব্যক্তি যিনি বিভিন্ন মাস, দিবস ও নির্দিষ্ট সময়কেন্দ্ৰিক কল্যাণের মৌসুমগুলোকে মূল্যায়ন করেন এবং সংশ্লিষ্ট ইবাদত ও আনুগত্যমূলক আমল করে মাওলার সান্নিধ্য লাভ করেন!

আমি আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

﴿سَابِقُوٓاْ إِلَىٰ مَغۡفِرَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ وَجَنَّةٍ عَرۡضُهَا كَعَرۡضِ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أُعِدَّتۡ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦۚ ذَٰلِكَ فَضۡلُ ٱللَّهِ يُؤۡتِيهِ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ٢١﴾ [الحديد: ٢١] 

“তোমরা অগ্রণী হও তোমাদের রবের ক্ষমা ও সে জান্নাত লাভের প্রয়াসে, যা প্রশস্ততায় আসমান ও যমীনের প্রশস্ততার মতো, যা প্রস্তুত করা হয়েছে তাদের যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে তিনি এটা দান করেন; আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।”[২৭]

ড. আব্দুল মুহসিন ইবন মুহাম্মাদ আল-কাসেম
সম্পাদনা: প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


[১] সূরা আল-ফজর: ১-২।
[২] সূরা আল-বাকারা: ১৯৭।
[৩] সহীহ ইবনে হিব্বান।
[৪] সহীহ বুখারী: ৯৬৯
[৫] সূরা আল-হাজ্জ: ২৮।
[৬] মুসনাদে আহমাদ: ৫৪৪৬।
[৭] ইমাম বুখারী মু‘আল্লাক সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন।
[৮] সহীহ বুখারী: ৫৩৫২, সহীহ মুসলিম: ২৯৮২।
[৯] সহীহ মুসলিম: ১১৬২।
[১০] সহীহ মুসলিম: ১৩৪৮।
[১১] সূরা গাফির: ১৪।
[১২] সূরা ইয়াসীন: ৮২।
[১৩] আবু দাউদ: ১৭৬৫।
[১৪] মুসনাদে আহমাদ: ১১৭৬২।
[১৫] সূরা আত-তাওবা: ৩।
[১৬] সূরা আল-মায়েদা: ৩।
[১৭] সহীহ মুসলিম: ১২১৮।
[১৮] সহীহ বুখারী: ১৭৪১, সহীহ মুসলিম: ১৬৭৯।
[১৯] সহীহ বুখারী: ১৭৪১।
[২০] সূরা আল-বাকারা: ২০৩।
[২১] সহীহ মুসলিম: ১১৪১।
[২২] সূরা আল-কাউসার: ২।
[২৩] সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭।
[২৪] সহীহ বুখারী: ৫৫৬৫, সহীহ মুসলিম: ১৯৬৬।
[২৫] সহীহ মুসলিম: ১৯৭৭।
[২৬] সূরা আত-তাওবা: ৩৬।
[২৭] সূরা আল-হাদীদ: ২১।
Share on