আল্লাহ আরশের উপর — আহলুস সুন্নাহর ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাস ও জাহমিয়াহর ভ্রান্ত মতবাদ
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
ইবনু আবি হাতিম তাঁর আল-রাদ্দ ‘আলা আল-জাহমিয়্যাহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, সাঈদ ইবনু ‘আমির আদ-দুবাইই (বাসরার ইমাম, ইমাম আহমাদের শাইখদের একজন) এর কাছে জাহমিয়াদের কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন: “তাদের মতবাদ ইয়াহূদী-নাসারাদের থেকেও খারাপ। কারণ ইয়াহূদী, নাসারা ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মুসলিমদের সঙ্গে একমত যে, আল্লাহ আরশের উপর আছেন; অথচ এরা (জাহমিয়াহ) বলে—আরশের উপর কিছুই নেই।”[১]
আল-‘আল্লামাহ শায়খ সালেহ আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ বলেন:
কারণ ইয়াহূদী ও নাসারা আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলী স্বীকার করে। কিন্তু জাহমিয়াহ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী অস্বীকার করে। তাই তারা ইয়াহূদী-নাসারার থেকেও খারাপ। ইয়াহূদী-নাসারা আহলুল কিতাব। তাদের কিতাবগুলোতে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী আছে। তারা সেগুলোতে মূলত ঈমান রাখে, যদিও বিকৃতি করেছে। কিন্তু জাহমিয়াহ—তারা সব কিতাবকেই অস্বীকার করেছে: কুরআন, তাওরাত, ইঞ্জিল—সব আসমানী কিতাবের বিরোধিতা করেছে। (নাঊযুবিল্লাহ) তাই ইয়াহূদী-নাসারা যতই খারাপ হোক না কেন, জাহমিয়াহ তাদের থেকেও বেশি খারাপ।
তিনি বলেন: “ইয়াহূদী-নাসারা ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মুসলিমদের সাথে একমত যে, আল্লাহ আরশের উপর আছেন। কিন্তু জাহমিয়াহ বলে: আরশের উপর কিছুই নেই।”[২]
ইমাম আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
আবদুর রহমান ইবনু আবি হাতিম বলেন, আমার পিতা বর্ণনা করেছেন, তাঁকে বলা হয়েছিল যে সাঈদ ইবনু ‘আমির আদ-দুবাইই জাহমিয়াদের সম্পর্কে বলেছেন: “তাদের মতবাদ ইয়াহূদী-নাসারার থেকেও খারাপ। কারণ ইয়াহূদী, নাসারা ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মুসলিমদের সাথে একমত যে, আল্লাহ আরশের উপর আছেন; অথচ এরা বলে: আরশের উপর কিছুই নেই।”[৩]
শায়খ আবদুল ‘আযীয আর-রাজিহি হাফিযাহুল্লাহ বলেন:
ইয়াহূদী-নাসারা ও মূর্তিপূজকরা স্বীকার করেছে যে, আল্লাহ আছেন এবং তিনি আরশের উপর আছেন। কিন্তু এরা (জাহমিয়াহ) আল্লাহর অস্তিত্বই অস্বীকার করেছে। কারণ যখন তারা আল্লাহর উলূ অস্বীকার করল এবং বলল: “আল্লাহ সবখানে আছেন” অথবা “না জগতের ভেতরে, না বাইরে”—তাহলে তারা বাস্তবে আল্লাহর অস্তিত্বই অস্বীকার করল। তাদের কথার অর্থ এমন, যেভাবে আবদুল মালিক ইবনু মারওয়ান বলেছেন: “তারা বলে: আরশের উপর কোনো ইলাহ নেই।” সুতরাং ইয়াহূদীরা এর তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে, কারণ তারা অন্তত রবের অস্তিত্ব এবং তাঁর ঊর্ধ্বে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। আর জাহমিয়াহ বলেছে: “উপরে কোনো রব নেই।”[৪]
আল্লাহ বলেন:
﴿إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْش﴾
“নিশ্চয়ই তোমাদের রব আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, অতঃপর আরশের উপর উঠেছেন।”[৫]
ইবনু তাইমিয়াহ বলেন:
আল্লাহ যে বিশ্বজগতের উপর, আরশের উপর আছেন—এ ব্যাপারে কেবল জাহমিয়াহ ও তাদের অনুসারীরাই মতভেদ করেছে।[৬]
তিনি আরও বলেনঃ:
সব নবী একই বিষয়ের উপর একমত হয়েছেন যে আল্লাহ উলূ-তে আছেন (উপরে, আরশের উপর)। কুরআন ও সুন্নাহতে এর প্রায় হাজারো দলীল আছে। পূর্ববর্তী নবীদের এমন বক্তব্য যে কত তার হিসাব নেই।[৭]
আল্লাহ বলেন:
﴿ءَأَمِنتُم مَّن فِى ٱلسَّمَآءِ أَن يَخْسِفَ بِكُمُ ٱلْأَرْضَ…﴾
“তোমরা কি নিশ্চিন্ত হলে সেই সত্তার থেকে, যিনি উপরে আছেন—যেন তিনি তোমাদেরকে জমিনে ধসিয়ে দেন?…”[৮]
ইমাম তাবারী বলেন:
﴿مَن في السماء﴾ (যিনি উপরে আছেন) অর্থাৎ আল্লাহ।[৯]
ইবনু আল-জাওযি বলেন:
﴿مَن في السماء﴾ (যিনি উপরে আছেন) ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ: “উপরে যে আছেন তার আযাবের কথা, আর তিনি হলেন মহান আল্লাহ তা’আলা।”[১০]
ইমাম ইবনু বাজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়: “আল্লাহ কোথায়?” তাহলে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ বলবে: “আল্লাহ আসমানে, আরশের উপরে।” যে বলবে: “তিনি সর্বত্র আছেন”—সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। এ কারণে সে কাফির। তাকে তওবার জন্য আহ্বান করা হবে, তওবা না করলে তাকে হত্যা করা হবে। কারণ এর মানে হলো আল্লাহর উলূ অস্বীকার করা, আরশের উপরে থাকার বিষয় অস্বীকার করা, যা আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।[১১]
ইবনু তাইমিয়াহ বলেন:
আরশ সৃষ্টির উপরে, আর স্রষ্টা সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার উপরে আছেন।[১২]
তিনি আরও বলেন:
আল্লাহ তাঁর কিতাবে এবং রাসূল ﷺ-এর জবানীতে নিজেকে উচ্চে, আরশের উপর এবং সৃষ্টির উপরে বলে বর্ণনা করেছেন।
কিছু শাফেয়ি উলামা বলেছেন: কুরআনে হাজারেরও বেশি দলীল আছে যে আল্লাহ সৃষ্টির উপরে, বান্দাদের উপরে আছেন। অন্যরা বলেছেন: তিনশত দলীল আছে।[১৩]
সংক্ষেপে:
- সব নবী, সব আসমানী কিতাব, এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ এ বিষয়ে একমত—আল্লাহ আসমানে, আরশের উপর আছেন।
- জাহমিয়াহ একমাত্র দল যারা আল্লাহর উলূ অস্বীকার করেছে।
- তাই তারা ইয়াহূদী-নাসারা থেকেও বেশি বিভ্রান্ত।
- যারাই আল্লাহকে উপরে থাকার কথা মানতে অস্বীকার করবে তারাই জাহমী।
- [১]আল-ফাতওয়া আল-হামাউইয়্যা আল-কুবরা, পৃষ্ঠা ৩৩৬।
- [২]শরহ আল-হামাউইয়্যা আল-কুবরা, পৃষ্ঠা ৪২৯।
- [৩]আল-‘উলূ লিল ‘আলী আল-গাফ্ফার, পৃষ্ঠা ১৫৮।
- [৪]ইবনু তাইমিয়াহর আল-হামাউইয়্যা ব্যাখ্যা, পাঠ নং ৫।
- [৫]সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ৫৪।
- [৬]বায়ান তালবিস আল-জাহমিয়্যাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৬৭-১৬৮।
- [৭]আল-জাওয়াব আস-সাহীহ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩১৮।
- [৮]সূরা আল-মুলক ১৬-১৭।
- [৯]তাফসীর আত-তাবারী, খণ্ড ২৩, পৃষ্ঠা ৫১৩।
- [১০]জাদুল মাসীর ফি ‘ইলম আত-তাফসীর, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩১৬।
- [১১]ফাতাওয়া নূর ‘আলা আদ-দারব, ইবনু বাজ, আশ-শুয়াই‘আর এর তত্ত্বাবধানে, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৪০।
- [১২]মাজমু‘ আল-ফাতাওয়া, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৫৬৪।
- [১৩]মাজমু‘ আল-ফাতাওয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১২১।