আহলুস সুন্নাহ কারা?
শাব্দিক অর্থে ‘আহলুস সুন্নাহ’ কথাটি দুটি শব্দ দিয়ে ঘটিত। ‘আহল’ মানে পরিবার বা ধারক-বাহক। আর ‘সুন্নাহ’ এর দ্বারা আভিধানিকভাবে উদ্দেশ্য আদর্শ, পথ, বর্ণনা।
আর পারিভাষিক অর্থে, আকীদা ও মানহাজে যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ অনুসরণ করে চলে।
এ হিসাবে আকীদা ও মানহাজে যারা সালাফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কিরাম ও তাদের সুন্দর অনুসারী তাবেঈ, তাবেঈন ও ফিকহের ইমামগণ, হাদীসের বিখ্যাত ইমামগণের মত ও পথকে আঁকড়ে ধরে কেবল তাদেরকেই বুঝাবে।
কিছু লোককে দেখা যায় তারা আহলুস সুন্নাহর সংজ্ঞা প্রসারিত করে তিনটি দলকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তারা বলেন:
প্রথম দল: আছারিয়্যাহ, যাদের ইমাম হচ্ছেন সালাফগণের নীতির সারসংক্ষেপ পেশকারী ইমাম আহমদ রাহিমাহুল্লাহ।
দ্বিতীয় দল: ‘আশআরিয়্যাহ, যাদের ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরি।
তৃতীয় দল: মাতুরিদিয়্যাহ, যাদের ইমাম আবু মনসুর আল-মাতুরিদি।
তারা এই তিনটি দলকেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহের অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। কিন্তু সন্দেহ নেই, আহলুস সুন্নাহ এর সংজ্ঞায় এই ধরণের প্রসার গ্রহণযোগ্য নয়।
কেননা, যদি আমরা বলি: আছারিয়্যাহ (আসল সুন্নাহর অনুসারী) সুন্নাহর ওপর আমল করেছেন, তারা বিশ্বাসে বা ফিকহের শাখা-প্রশাখায় সুন্নাহর বিরোধিতা করেননি—তাহলে তাদের ওপর আহলুস সুন্নাহ নামকরণ করার পূর্ণ অধিকার আছে। আর ইমাম আহমদ—যেমনটি সুপরিচিত—তিনি-ই তো আহলুস সুন্নাহর ইমাম।
আশআরিয়্যাহ ও মাতুরিদিয়্যাহ মতবাদের অনুসারীদের সে অবস্থা ও অবস্থান নেই। আকীদা ও মানহাজের ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে প্রচুর বিভ্রান্তি।
যদি আমরা আশআরিয়্যাহ ও মাতুরিদিয়্যাহদের দিকে তাকাই—তারা কি আকীদার ক্ষেত্রে হাদীসগুলোকে গ্রহণ করেন এবং সেগুলোর অর্থকে যেমন এসেছে তেমনই মানেন? আল্লাহ যেসব সিফাত (গুণাবলী) তাঁর জন্য কুরআনে সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর নবী ﷺ তাঁর জন্য সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলো কি তারা সালাফে সালিহীনের পদ্ধতি অনুযায়ী স্বীকার করেন? না। বরং তাদের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধিতা আছে, তারা সালাফে সালিহীনের মানহাজ থেকে বিচ্যুত। সুতরাং তাদেরকে আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত করা এক ধরনের প্রসার হলেও, এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এভাবে আমরা বুঝব: মানুষ কী বিশ্বাস করে, তার উপর ভিত্তি করে তাকে বিচার করতে হবে। আবার তার ব্যক্তিত্বের দিকেও তাকাতে হবে। হতে পারে, একজনের বিশ্বাস আরেকজনের মতোই, কিন্তু আমরা একজনকে ক্ষমা করব আরেকজনকে ক্ষমা করব না; একজনের সাথে নম্রভাবে আচরণ করব, আরেকজনের সাথে কঠোরভাবে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা রাযী ও নওয়াওয়ীর দিকে তাকাই—দুজনেই আবুল হাসান আল-‘আশআরির অনুসারী হওয়ার দাবিদার। কিন্তু আমরা কি নওয়াওয়ীকে রাযীর মতো আচরণ করব? না। নববী আকীদার ব্যাপারে একজন সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন, কিন্তু রাযী ছিলেন একজন মনায্জির (দার্শনিক বিতর্ককারী), যিনি ইমাম আশআরীর মতবাদকে দার্শনিক ও কালাম শাস্ত্রীয় জটিলতার মতো নিকৃষ্ট বক্তব্যের প্রবক্তা ছিলেন, যেমন জবরিয়্যাহর মতবাদ। তিনি তাঁর বইতে এমন সব সন্দেহ (শুবহাত) এনেছেন, যেগুলোর জবাব তিনি নিজেই দিতে পারেননি। সুতরাং নওয়াওয়ীর ব্যাপারে আমরা যেমন আচরণ করব, রাযীর সাথে তা করব না।
আদল ও ইনসাফ অবশ্যই জরুরি—
আল্লাহ বলেন,
﴿وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ﴾
“কোনো কওমের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায়বিচার থেকে বিরত না রাখে।”[১]
হ্যাঁ, নাওয়াওয়ী আশআরী ছিলেন। এই দিক থেকে তিনি আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত নন। কিন্তু তারপরও আমরা বলব না যে তিনি সম্পূর্ণভাবে বাতিল। কারণ, তাঁর অনেক গুণাবলী ছিল:
- তিনি সুন্নাহর খেদমত করেছেন।
- দুনিয়া থেকে বিমুখ ছিলেন।
- আখিরাতের দিকে মনোযোগী ছিলেন।
- আল্লাহর শরিয়তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
অন্যদিকে রাযীর ব্যাপারে বলা যায়, তিনি গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত। যদি প্রমাণিত হয় যে তাঁর আস-সিররুল মাকতূম নামে গ্রন্থটি তাঁরই, তবে এর বিষয়বস্তু হলো— জাদু ও জ্যোতিষশাস্ত্র। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক পথ। এমনকি বলা যেতে পারে, যদি এ গ্রন্থ তাঁরই হয়, তবে তা তাঁর রিদ্দাহ (ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া)-র প্রমাণ।
সর্বোপরি, দুজনই আশআরী। তবে একজনের সাথে আরেকজনের আচরণ এক হওয়া উচিত নয়।
আরও একটি উদাহরণ—শাইখুল ইসলাম ইবনু-তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ)-এর কাছ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এমন এক জনপদ সম্পর্কে, যেখানে লোকেরা কবর তাওয়াফ করে। তিনি তাদেরকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। আবার আরেকটি প্রশ্ন আসলো—একই ধরণের—কিন্তু তিনি তাদেরকে কাফির বলেননি, বরং অজ্ঞতার অজুহাতে তাদেরকে ক্ষমা করেছেন। এর কারণ হলো: প্রথম জনপদে তিনি দেখেছিলেন, তাদের কাছে হুজ্জত (প্রমাণ) পৌঁছে গেছে—তাদের কোনো অজুহাত নেই। অন্যদিকে দ্বিতীয় জনপদে তিনি দেখেছিলেন, তাদের কাছে হুজ্জত পৌঁছেনি—তাই তাদের জন্য ওজরের অজুহাত দেওয়া হয়েছে।
তাহলে কি উভয় ক্ষেত্রকে একইভাবে বিবেচনা করা হবে? না। একইভাবে নয়। কারণ, হুজ্জত পৌঁছানো শর্ত, কারো উপর চূড়ান্ত ফয়সালা জারি করার আগে।
(শাইখ আব্দুল করীম আল-খুদাইর-এর দুরুস থেকে আলোকিত)
- [১]সূরা মায়েদাহ: ৮।