বকর ইবনে আবদুল্লাহ আবু যায়েদ
নাম ও বংশ পরিচয়:
বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আবু যায়েদ। ইসলামী জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। তাঁর পূর্ণ নাম বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আবু যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বকর ইবনে উসমান ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে গায়হাব ইবনে মুহাম্মাদ। তিনি কুদা‘আ গোত্রভুক্ত প্রসিদ্ধ ‘বনু যায়েদ’ বংশের সন্তান, যার শিকড় প্রসারিত হয়েছিল নাজদের ‘আল-ওয়াশম’ অঞ্চলে। ১৩৬৫ হিজরীতে এই অঞ্চলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।
শিক্ষাজীবন:
শাইখের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় মক্তবে, যেখানে তিনি শৈশবে কুরআন ও প্রাথমিক জ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেন। ১৩৭৫ হিজরীতে তিনি রিয়াদে চলে যান এবং সেখানে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় পুরোদমে।
সেখানে তিনি একে একে প্রাথমিক শিক্ষা, ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক স্টাডিজ এবং পরবর্তীতে শরীয়াহ অনুষদ থেকে ১৩৮৭/৮৮ হিজরীতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
জ্ঞান সাধনা:
শাইখ আবু যায়েদ কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন সেই যুগের বড় বড় মাশায়েখের দরবারের অনন্য তালিবে ইলম। রিয়াদ, মক্কা ও মদিনা—তিন পবিত্র নগরীতেই তিনি জ্ঞানসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।
রিয়াদে:
বিচারপতি শাইখ সালেহ বিন মুতলিক রাহিমাহুল্লাহর নিকট ‘মাকামাতে হারিরী’—এর পঁচিশটি মাকামাত মুখস্থ করেন।
পাশাপাশি তিনি ‘যাদুল মুস্তাকনি’ কিতাবের ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়টি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।
মক্কায়:
শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহর নিকট ১৩৮৫ হিজরীতে হজের মৌসুমে ‘আল-মুনতাকা’ কিতাব থেকে হজ সম্পর্কিত মাসায়েল পড়েন।
শাইখ সুলাইমান বিন হামদান রাহিমাহুল্লাহর কাছ থেকে তিনি সমস্ত হাদীসগ্রন্থের লিখিত ইজাযত লাভ করেন।
মদিনায়:
আবারো শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লাহর সংস্পর্শে এসে দুই বছর কাটিয়ে তার কাছ থেকে ইলমে ফিকহ, হাদীস, আকীদাহ ও অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করেন।
দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী তিনি শাইখ মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানকিতি রাহিমাহুল্লাহর সান্নিধ্যে থেকে তাফসীর ও অন্যান্য দীনি বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে তিনি ১৩৯৯/১৪০০ হিজরীতে “আল-মা‘আহাদ আল আ‘লা লিল কাদায়ি” (উচ্চতর বিচার বিভাগীয় ইনস্টিটিউট) থেকে মাস্টার্স ও ১৪০৩ হিজরীতে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব:
স্নাতক শেষ করেই ১৩৮৮ হিজরীতে তিনি মদিনার বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৪০০ হিজরী পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিষ্ঠার সাথে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
১৩৯০ হিজরীতে তাকে মসজিদে নববীতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং পরবর্তী ১০ বছর তিনি সেখানে দীনের খেদমত করেন।
১৩৯১ হিজরীতে তিনি মসজিদে নববীর ইমাম ও খতীব নিযুক্ত হন। তিনি এই মহান দায়িত্বে ছিলেন ১৩৯৬ হিজরী পর্যন্ত।
১৪০৫ হিজরীতে তাকে আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিকহ একাডেমিতে সৌদি আরবের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নিযুক্ত করা হয় এবং পরে সভাপতি করা হয়।
তিনি ছিলেন ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’র ফিকহ কাউন্সিলের সদস্য এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, গবেষণা কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
গ্রন্থাবলি ও গবেষণা কর্ম:
শাইখ আবু যায়েদ ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ গবেষক ও সুদক্ষ লেখক। তিনি প্রায় ৬৫টির বেশি মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার লেখনি ছেয়ে আছে ফিকহ, হাদীস, আখলাক, ইতিহাস ও সমসাময়িক জ্ঞানের শাখায়।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলি:
ফিকহুল ক্বাদ্বাইয়া আল-মু‘আসিরাহ
লা জাদীদা লি আহকামিস সালাত
ফাতওয়াস্ সায়িল আন মুহিম্মাতিল মাসায়িল
হিলইয়াতু তালিবিল ইলম
আত-তা‘সীল লি উসূলিত তাখরীজি ওয়া ক্বওয়া‘ইদিল জারহি ওয়াত-তা‘দীল
আল-মাদখালুল মুফাসসাল ইলা মাজহাবিল ইমাম আহমাদ
মাদীনাতুন নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফী রা’য়িল ‘আইন
আর-রুদূদ
আন-নাযায়ির
তাকরীবু আদাবিল হাদীস ওয়াল মুনাযারা
হুকমুল ইনতিমা ইলাল ফিরাক্ব ওয়াল আহযাব ওয়াল জামা‘আত আল-ইসলামিইয়াহ
খাসায়িসু জাজিরাতিল আরব
হিরাসাতুল ফাদ্বীলাহ (বর্তমান অনূদিত) প্রভৃতি গ্রন্থাবলি।
মৃত্যু:
এই মহান বিদ্বান ১৪২৯ হিজরী সালের মুহাররম মাসের ২৮ তারিখ, মঙ্গলবার (২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি) সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে মারা যান।
