bn বাংলা
বাংলা বাংলা
English English
عربي عربي


+8801575-547999
সকাল ৯টা হতে রাত ১০টা
Community Welfare Initiative

দাফনের পর মৃতকে তালকীন—সুন্নাহ নাকি বিদ‘আত?

প্রশ্ন: অনেকে যখন মৃতকে কবর দেওয়া শেষ করে তখন তার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে এভাবে তালকীন করে: “হে আল্লাহর বান্দা, এবং তাঁর দাসীর সন্তান! যখন তোমার কাছে দুই ফেরেশতা আসবে—যারা তোমাকে এবং তোমার মতো মুহাম্মাদ ﷺ এর উম্মতদের প্রশ্ন করার জন্য নিযুক্ত—তখন যেন তারা তোমাকে ভয় না দেখায়, আতঙ্কিত না করে। জেনে রাখো তারা আল্লাহর সৃষ্টি, যেমন তুমি আল্লাহর সৃষ্টি। যদি তারা জিজ্ঞেস করে: তোমার রব কে? তোমার দীন কী? তোমার নবী কে? তুমি কোন পথ অনুসরণ করেছিলে? তুমি কোন ধর্মে জীবন কাটিয়ে মারা গেলে? তখন তুমি স্বচ্ছ জিহ্বায়, নির্ভয়ে, দ্বিধাহীনভাবে বলো: আল্লাহ আমার রব, সত্যই; মুহাম্মাদ আমার নবী, সত্যিই; ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আমার পিতা, তাঁর দীনই আমার দীন; কাবা আমার কিবলা; আমি জীবন কাটিয়েছি এবং মারা গেছি এ কথার ওপর যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। যদি তারা আবার প্রশ্ন করে: তোমাদের মাঝে পাঠানো সেই মানুষ সম্পর্কে তুমি কী বলো? তখন বলবে: তিনি আমাদের নবী, আমাদের সুপারিশকারী, আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ … ইত্যাদি।”

উত্তর: এই তালকীন উদ্ভাবিত (বিদ‘আত), এর কোনো প্রমাণ নেই রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে। একদল আলিম একে বিদ‘আত বলেছেন।

  • ইমাম ইযযুদ্দীন ইবন আব্দুস সালাম বলেছেন: “তালকীনের ব্যাপারে কিছুই সহীহ হয়নি; এটি বিদ‘আত। আর নবী ﷺ এর হাদীস ‘لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لاَ إلهَ إِلاَّ اللهُ’ (তোমরা তোমাদের মৃতদেরকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ স্মরণ করিয়ে দাও) এর অর্থ হলো—যার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, আর যার জীবনের আশা নেই।”[১]
  • ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ থেকেও মৃত্যুর পর তালকীনকে অপছন্দনীয় বলা হয়েছে।[২]
  • ইবন কুদামা আল-মাকদেসী বলেন, “কবর দেওয়ার পর তালকীন সম্পর্কে ইমাম আহমাদ থেকে আমি কিছুই পাইনি এবং ইমামদের কারো স্পষ্ট মতামতও জানি না—শুধু এটুকু পেয়েছি যে, আহমাদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: এই প্রথা কী, যখন মৃতকে কবর দেওয়া হয়, তখন কেউ দাঁড়িয়ে বলে: ‘হে অমুকের সন্তান অমুক! তুমি যে অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছ তা স্মরণ রেখো—শাহাদাহ (لا إله إلا الله)’ ইমাম আহমাদ উত্তর দেন: আমি এ কাজ কাউকে করতে দেখিনি, শুধু শামবাসীদের ছাড়া। যখন আবুল মুগীরার মৃত্যু হয়েছিল, তখন একজন এসে এভাবে বলেছিল। আর আবুল মুগীরা বর্ণনা করতেন আবু বকর ইবন আবি মারইয়াম থেকে, তিনি আবার তাঁর শাইখদের থেকে যে তারা এটি করতেন।”[৩]
  • শাইখ মারদাওয়ী বলেছেন, যদিও হাম্বলী মাযহাবে কবর-পরবর্তী তালকীন সমর্থিত হয়েছে, “কিন্তু আমার অন্তর এর প্রতি ঝোঁক দেয় না।”[৪]
  • শামসুল হক আজিমাবাদী বলেন, “মৃত্যুর পর তালকীন সম্পর্কে অনেক আলিম নিশ্চিত করেছেন যে এটি নতুন বিষয়।”[৫]
  • ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “রাসূল ﷺ কখনো কবরের পাশে বসে কুরআন পাঠ করতেন না, মৃতকে তালকীন করতেন না, যেমন আজকের দিনে মানুষ করে।”[৬]

বিদ‘আতীদের কিছু সন্দেহের জবাব:
যে হাদীসে আবু উমামাহ রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মৃতকে কবরের পর তালকীন করার কথা এসেছে—শাইখ আলবানী একে “মুনকার” বলেছেন। এর সনদ খুবই দুর্বল, এমনকি হাদীসকে মাওদ্বু বি মনগড়া বলেও আলিমরা মন্তব্য করেছেন।[৭] তাছাড়া ইমাম নওয়াওয়ী, ইবনুস সালাহ, ইরাকি প্রমুখও এটিকে দুর্বল বলেছেন।
ইবন হাজার রাহিমাহুল্লাহও বলেছেন: “এটি গরীব হাদীস এবং এর দুই সনদের শিকলই খুবই দুর্বল।”[৮]
সান‘আনী বলেন: “গবেষক ইমামদের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়—এটি দুর্বল হাদীস, এবং এর ওপর আমল করা বিদ‘আত। বহু মানুষ করলেও এতে প্রতারিত হওয়া যাবে না।”[৯]

এ বিদ‘আত প্রসারকারীরা আরো যে হাদীস এনেছেন তা হচ্ছে:
আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে নবী ﷺ বলেন,

لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لاَ إلهَ إِلاَّ اللهُ

“তোমরা তোমাদের মৃতদেরকে লা ইলাহা ইলাল্লাহ মনে করিয়ে দাও।”[১০]

কিন্তু এ হাদীসের অর্থ হলো মৃত্যুপথযাত্রীকে তালকীন করা, কবর দেওয়ার পর নয়।
• ইমাম নওয়াওয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এখানে ‘مَوْتَاكُمْ’ (তোমাদের মৃতরা) বলতে বুঝানো হয়েছে মৃত্যুপথযাত্রীকে। অর্থাৎ তাকে لا إله إلا الله স্মরণ করিয়ে দাও যাতে এটি হয় তার শেষ কথা।”[১১]
এছাড়াও অনেক হাদীসে প্রমাণ আছে—“যার শেষ কথা لا إله إلا الله হবে সে জান্নাতে যাবে।”
কবর দেওয়া শেষ হলে সুন্নাহ হলো মৃতের জন্য মাগফিরাত চাওয়া এবং তার জন্য দোয়া করা।
ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “রাসূল ﷺ যখন কবর দেওয়া শেষ করতেন, তখন তিনি ও সাহাবারা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃতের জন্য দো‘আ করতেন এবং তাঁকে দৃঢ়তার জন্য দো‘আ করতে আদেশ দিতেন।”[১২]
এ ব্যাপারে উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীস আছে:
রাসূল ﷺ বলেন, “তোমাদের ভাইয়ের জন্য মাগফিরাত প্রার্থনা করো এবং তার জন্য দৃঢ়তা চাও, কারণ এখনই তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে।”[১৩]

সারসংক্ষেপ:

  • মৃত্যুপথযাত্রীকে শাহাদাহ মনি করিয়ে দেওয়া সুন্নাহ।
  • কবর দেওয়ার পর মৃতকে তালকীন করানো বিদ‘আত; কারণ রাসূল ﷺ বা সাহাবীদের থেকে এর কোনো সহীহ প্রমাণ নেই।
  • কবর দেওয়ার পর সুন্নাহ হলো—তার জন্য মাগফিরাত প্রার্থনা ও দৃঢ়তার দো‘আ করা।
  1. [১]ফাতাওয়া ইয্য ইবন আবদুস সালাম, পৃ. ৪২৭।
  2. [২]কিফায়াতুত তালেবির রাব্বানী, আল আয়াতুল বাইয়্যেনাত লিল আলূসী, পৃ. ৬৩-৬৪।
  3. [৩]ইবন কুদামা, আল-মুগনি (২/৩৭৭)।
  4. [৪]আল-ইনসাফ (২/৫৪৯)।
  5. [৫]আউনুল মা‘বূদ (৮/২৬৮)।
  6. [৬]যাদুল মা‘আদ (১/৫২২)।
  7. [৭]আস-সিলসিলাতুদ্বয়ীফাহ (২/৬৪-৬৫)।
  8. [৮]আল-ফাতূহাতুর রাব্বানিয়্যাহ (৪/১৯৬)।
  9. [৯]সুবুলুস সালাম (২/২৩৪)।
  10. [১০]সহীহ মুসলিম: ২১৬২।
  11. [১১]শারহু মুসলিম (২/৫১২)।
  12. [১২]যাদুল মা‘আদ (১/৫২২)।
  13. [১৩]আবু দাউদ, বায়হাকি, হাকিম; সহিহ বলেছেন আলবানী।
Share on